
শ্রেণি – দশম | বিভাগ – দশম শ্রেণির প্রশ্ন উত্তর | অধ্যায় – ইতিহাসের ধারণা
প্রশ্ন উত্তর আলোচনায় রইল দশম শ্রেণির ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় ইতিহাসের ধারণা থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর আলোচনা।
প্রশ্ন – ইতিহাসচর্চায় উপাদান হিসাবে বঙ্গদর্শনের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর – ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে ‘বঙ্গদর্শন’।
সকল পাঠকের জন্য বঙ্গদর্শন
‘বঙ্গদর্শন’ বাংলা পত্রপত্রিকার ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণকে সূচিত করে। ‘বঙ্গদর্শনে’র পূর্বে প্রকাশিত সাময়িকপত্রগুলির মধ্যে বেশিরভাগই খুব বেশিদিন চলেনি। এমনকি ‘বঙ্গদর্শনে’র সমসাময়িক আর দুটিমাত্র পত্রিকা বিংশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল – ‘তত্ত্ববোধিনী’ ও ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা। এগুলি ছিল নীরস শিক্ষামূলক পত্রিকা।
সেসময় বাংলায় আনন্দপাঠের উপযুক্ত লেখার মধ্যে একদিকে ছিল রামায়ণ-মহাভারত, বাংলা আরব্য রজনী, বেতাল পঞ্চবিংশতি আর অন্যদিকে ছিল পত্রপত্রিকার ভারী ভারী প্রবন্ধ।
কিশোর মনের চাহিদা নিবৃত্তি ঘটাতে পারে এমন লেখা ছিল বিরল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা নবীনচন্দ্র সেনের মত সে যুগের প্রথিতযশা বাঙালির আত্মজীবনীতে এই নিয়ে খেদ ঝরে পড়েছে। এই শূন্যতা ভরাট করতে বিভিন্ন রুচির পাঠযোগ্য রচনার ডালি সাজিয়ে হঠাৎ হাজির হয় ‘বঙ্গদর্শন’।
সাহিত্য রচনায় বঙ্গদর্শন
কবিতা, নাটক-নভেল, প্রবন্ধ, সমালোচনামূলক রচনার সাথে সাথে বাংলা প্রকাশনার জগতেও ‘বঙ্গদর্শন’ জোয়ার আনে। এখানে প্রকাশিত হবার পর অনেক উপন্যাসই বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্কিমের বেশিরভাগ কিংবদন্তী সৃষ্টি যেমন ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘রজনী’, ‘আনন্দমঠ’, ‘রাধারানী’, ‘ইন্দিরা’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রথম বঙ্গদর্শনেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
রম্যরচনা ছাড়াও এখানে সমসাময়িক দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্যবিষয়ক লেখা থাকত।
পাশ্চাত্য ইতিহাস ও সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে বাঙালি মানসে ইউরোপীয় ধাঁচের জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়। ‘আনন্দমঠে’র বন্দেমাতরম সঙ্গীত অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
আরো পড়ো → দশম শ্রেণির ইতিহাসের প্রশ্ন উত্তর আলোচনা
আধুনিক গদ্যবিন্যাসে বঙ্গদর্শন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুব সচেতনভাবেই এক দেশজ বাংলা গদ্যরীতি তৈরী করতে চেয়েছিলেন। তাই সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি সাহিত্য থেকে ধার করার পাশাপাশি যেখানেই সম্ভব হয়েছে সেখানেই তিনি ওইসব শব্দের বঙ্গজ প্রতিশব্দ আমদানি করেছেন। এইভাবে বিশুদ্ধ বাংলা গদ্যের যে ধাঁচাটি তিনি তৈরী করে দেন বিংশ শতাব্দীর লেখকেরাও মূলতঃ সেটিকেই অনুসরণ করেছেন।
গদ্যরীতির পাশাপাশি পত্রিকার বিন্যাসের ক্ষেত্রেও পরবর্তীকালের ‘ভারতী’, ‘নব্যভারত’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলি ‘বঙ্গদর্শন’কে মডেল ঠাউরেছিল।
আরো পড়ো → দশম শ্রেণির বাংলা প্রশ্ন উত্তর আলোচনা
প্রতিথযশা সাহিত্যিকের কলমে বঙ্গদর্শন
প্রথম কয়েকটি খন্ডের পর ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তায় বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধে।
‘বঙ্গদর্শনে’র লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, লালবিহারী দে, রামগতি ন্যায়রত্ন, দীনবন্ধু মিত্রের মত নামজাদা ব্যক্তিত্ব।
আরও কিছু দিক থেকে ‘বঙ্গদর্শন’ পথপ্রদর্শক। ‘বঙ্গদর্শন’ পূর্ববর্তী যুগের বাজারী সাহিত্য বিক্রি হত ফুটপাথে। ওইসব বইয়ের কাগজের মানও খুব একটা ভালো ছিল না। ‘বঙ্গদর্শনে’র কাটতির সুবাদে লাইব্রেরীকে কেন্দ্র করে এক নতুন পাঠ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। পত্রিকার প্রচ্ছদ, কাগজ ও বাঁধাই ছিল রুচিশীল ভদ্রলোক পাঠকের মনমত।
বাঙালির মননে বঙ্গদর্শন
আগেকার সময়ে একজন বই বা সংবাদপত্র কিনলে দশ জন নিরক্ষর লোককে ডেকে পড়ে শোনানোর একটা চল ছিল। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সদস্যদের বাড়ি বাড়ি কপি পৌঁছে দেবার রীতি চালু করলে ধীরে ধীরে ভদ্রলোক বাঙালি নিভৃতপাঠে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের পিছনে বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমকালীন শিক্ষিত মননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো। সমসাময়িক পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলি এই পত্রিকায় উঠে আসত। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন রচনা এখানে প্রকাশিত হত। এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘বিজ্ঞানরহস্য’ সিরিজ এবং ‘কৃষ্ণচরিতে’র কথা উল্লেখ করা যায়।
রাজনৈতিক বিষয়ে ইউরোপে প্রচলিত তত্ত্বগুলোর সঙ্গে বাঙালির পরিচয়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল বঙ্গদর্শন। ভারতের আর্থ-সামাজিক বিষয়ে বঙ্কিমের চিন্তাভাবনাও প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গদর্শনের পাতায়।
‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক ভূমি-রাজস্ব নীতির দরুণ বাঙালি কৃষকের সঙ্গীন অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই পত্রিকাতেই বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিগত নিবন্ধ রচনার সূচনা করেছিলেন।
তাই বলা যায়, তৎকালীন বঙ্গসমাজের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসাবে বঙ্গদর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম।
WBPorashona.com-এর পোস্ট আপডেট নিয়মিত পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো → WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো → YouTube চ্যানেল
- লাইক করো → Facebook পেইজ
- সাবস্ক্রাইব করো → টেলিগ্রাম চ্যানেল
আমাদের কাজ থেকে উপকৃত হলে এই লেখাটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।